নেতাজি ও দিনাজপুর- ড. সমিত ঘোষ

ড. সমিত ঘোষ

 

নেতাজি ও দিনাজপুর: বিদ্রোহ, বিপ্লব ও প্রতিবাদ দিনাজপুরবাসীর মজ্জাগত। দিব্যোর বরেন্দ্র প্রজা বিদ্রোহ দিয়ে যার সূচনা, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে তার সমাপ্তি। ঔপনিবেশিকত্তোর সময়ে নানা উত্থান পতন হয়েছে। এসেছেন বিভিন্ন জননেতা। এদের মধ্যে অন্যতম ভারতবন্দিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

১৯২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দে পত্নীতলা ও ধামইরহাট অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ প্রকট রূপ নিলে ব্রিটিশ সরকারের উদাসীনতায় বিভিন্ন স্তরে প্রতিবাদ চলতে থাকে। পত্নীতলার কংগ্রেস নেতা অবিনাশ বসু ও অনিল বিশ্বাস প্রায় ৫০০ জন সত্যাগ্রহী নিয়ে বালুরঘাট ফৌজদারি আদালত প্রাঙ্গণে সরকারি উদাসীনতার প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করলে বাংলার গভর্নর জ্যাকসন সাহেব দিনাজপুরে আসেন। যোগেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কংগ্রেস প্রতিনিধিরা জ্যাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারী নিয়ে অবগত করান। গভর্নর সাহেব কলকাতা ফিরে যান এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের জন্য ৬ লক্ষ টাকা ত্রাণ বরাদ্দ্য হিসেবে মঞ্জুর করেন।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে নেতাজি অবিভক্ত দিনাজপুরের হিলিতে আসেন তখন হিলি ছিল বগুড়া জেলার অন্তর্গত। ওই বছরই ২৬ মে সুভাষচন্দ্র নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস করে ভোরে হিলিতে পৌঁছান হিলির জননেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার সহ আরো অনেকে সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানান। তাকে হিলির বারোয়ারীতলায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এরপর সারদা ভবন পাঠাগার পরিদর্শন করেন এবং পরিদর্শন খাতায় (Visitor’s book) মন্তব্য লিখে স্বাক্ষর করেন। হিলির জমিদার রায়বাহাদুর কুমুদনাথ এর পরিবারের সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিল। তিনি বালুরঘাট ও পত্নীতলায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। বালুরঘাটের চ্যাটার্জী বাড়িতে রাত্রিবাসও করেন। বালুরঘাটে আত্রাই নদীর পার্শ্ববর্তী মহারাজ বসুর বাড়ির সংলগ্ন মাঠে নতুন কংগ্রেস ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন এবং চ্যাটার্জি বাড়িতে তিনি গোপন মিটিংও করেন। নেতাজি প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (বি.ভি) -এর শাখা ছিল দিনাজপুরে।

নেতাজি I.C.S এর মত হেভেন সার্ভিস ত্যাগ করে ব্রিটিশ বিরোধিতার মাইল ফলক পুঁতে বঙ্গদেশের তরুণদের মন জয় করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চল পরিদর্শন করে উত্তরবঙ্গ সহ দিনাজপুরের মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পত্নীতলা, ধামইরহাট, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, হিলি, আক্কেলপুর, সান্তাহার, আদমদীঘি ইত্যাদি অঞ্চল। সুভাষচন্দ্র সান্তাহারকে কেন্দ্র করে ত্রাণকার্য শুরু করে সাধারণ মানুষের অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিলেন। দান হিসেবে চার লক্ষ টাকা ত্রাণ তহবিলে উঠেছিল।

দিনাজপুরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুভাষচন্দ্রকে কলকাতা থেকে সুদূর পল্লী অঞ্চলের জননায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে মান্যতা পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী। সুভাষের মা প্রভাবতী বসু বাসন্তী দেবীকে (চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী) বলতেন -“তুমিই সুভাষের আসল মা, আমি তো কেবল ধাত্রী।” সুভাষচন্দ্র ছিলেন আবেগী মানুষ। দেশবন্ধু তার নাম দিয়েছিলেন ক্রন্দিত অধিনায়ক (Crying Captain)। দেশবন্ধু বলতেন- “বাঙালি হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খ্রিস্টান হউক, বাঙালি বাঙালি। বাঙালির একটা বিশিষ্ট রূপ আছে, একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি আছে, একটা স্বতন্ত্র ধর্ম আছে।” দেশবন্ধু ভায়া সুভাষচন্দ্র হয়ে বঙ্গবন্ধুর লড়াইটা অনেক দীর্ঘ। আবার ক্ষমতার অলিন্দে শীর্ষস্থানের লড়াইয়ে গান্ধি-প্যাটেল বনাম দেশবন্ধু-সুভাষ এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিল। বিপ্লবী বীরাঙ্গনাদের শহীদায়নের লড়াই এ আমাদের প্রাপ্তি স্বাধীনতা।

error: Content is protected !!