বরই বৃত্তান্ত ও সরস্বতীপুজো – গোবিন্দ সরকার

গোবিন্দ সরকার

 

সরস্বতী পুজো:  প্রতিবছরই একটি শীতকালকে নীরবে চলে যেতে দেখি। সে একান্তে হেঁটে চলে নাড়া পড়ে থাকা ধূসর ধানক্ষেতের আলপথ বেয়ে। আর শৈশবের কিছু স্মৃতি ভিড় করে আসে বসন্ত পঞ্চমীর হাত ধরে।

সবেমাত্র তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। পড়াশুনার অত কিছু বুঝি না। দামাল ছেলেদের মতো ঘুরি এপাড়া থেকে ওপাড়া। আর সুযোগ পেলেই নদীর ধারে ছুটি বরই পারতে।

বাড়ির পাশেই বালিয়াই নদী। নদীর দু-ধারে সারি সারি করে প্রচুর বরইয়ের গাছ। মনুষ্যসৃষ্ট নয়, এমনিই গজিয়েছে। সুযোগ পেলেই পাড়ার ছেলেছোকরা মিলে চলে যাই বরই পারতে। ঢিল ছুড়ে বরই পারি। আর কোছা কোছা কচি বরই নিয়ে বাড়ি ফিরি।

মা বকে দেয়, ‘এখনই বরই পেরে খাসনে! আগে সরস্বতীপুজো হোক, তারপরে খাস।’
সবিস্ময়ে বলি, ‘কেন মা?’
— ‘মা সরস্বতী পাপ দিবে। কোনওদিন পরীক্ষায় পাশ করতে পারবিনে।’

মা’র সব কথা ধ্রুবসত্য মেনে নিই। পরীক্ষায় ফেল করবো— ভেবেই কেমন যেন গা রিরি করে ওঠে। তখন স্কুলে পাশফেল প্রথা ছিল। মা’র এই কথা শুনে এক অদৃশ্য ভয় আমাকে তাড়না করে। কারণ মা সরস্বতী তো অন্তর্যামী। সব দেখতে পাচ্ছেন।

তারপর থেকে কোনওবছরই সরস্বতীপুজো না হওয়া অবধি বরই মুখে তুলেনি। সব ফলেরই পরিপূর্ণ হতে একটা সময় লাগে। তেমনই বরই ডাঁসা হতে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পরে বুঝেছি মা কেন সরস্বতীপুজোর আগে বরই খেলে বকা দিত। সেই কচি বরই খেতে তো পারতামই না। অহেতুক শুধু নষ্ট হত।

রীতিমতো সরস্বতী পুজোর নির্ঘণ্ট বাজে। মনে নাম না জানা এক গভীর উচ্ছ্বাস। পুজোর দিন কাঁকভোরেই উঠে স্নান সেরে নিই। পরিষ্কার জামা কাপড় পরি। হাতে বই ও গাঁদাফুল নিয়ে স্কুলে ছুটি অঞ্জলি দিতে। স্কুলের মাষ্টারমশাইরা পরিষ্কার জামা কাপড় পরে সকালেই যেতে বলত। স্কুলে গিয়ে মা সরস্বতীর পাশে বই রেখে অঞ্জলি দিই। স্তোত্র জপ করি। আর পুজো শেষে খিচুড়ি। আহা, কী তৃপ্তি!

এখন বালিয়াই নদী বেয়ে কত কত সময় বয়ে গেছে। আগের মতো নদীর নাব্যতাও কমেছে। বর্ষাকালে নিয়ম মেনে আর বৃষ্টিও হয় না তেমন। কিন্তু নিয়ম মেনে সরস্বতীপুজোটা হয়। পার্থক্য শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের শিষ্টাচার, নৈতিকতায়। আগে মন্ডপে মন্ডপে ভিড় জমত অঞ্জলি দেওয়ার জন্য; এখন ভিড় জমায় সেলফি তোলার জন্য। যদিও শর্তাবলী প্রযোজ্যে ছোট্ট করে লেখাই যায় ‘ব’ স্কোয়ার ইক্যুয়ালটু ‘বাইক’ ও ‘বান্ধবী’।

error: Content is protected !!